( স্মৃতিচারণ মূলক লেখা)
মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় আমি থাকতাম হোস্টেলে।
আমরা একটা বড়ো flat এ মোট ছয়জন থাকতাম।
আমাদের একজন সিনিয়র আপু এম.বি.বি.এস. পাস করার পর চলে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হঠাত একদিন উনার রুমের দরজার পাশে দেখলাম পুরোনো অনেক গুলো নিউজ পেপারের সাথে, এই পাঞ্জে সূরা অজিফা লেখা বইটা মেঝে তে পরে আছে।
সেই বই এর পাশেই কয়েকটা জুতা…!
আমি মুহূর্তের মধ্যে বই টা হাতে তুলে নিয়ে সালাম করে, আমার কাছে রাখলাম। আপু তখন হসপিটালে ছিলেন।
রুমে ফেরার পর উনাকে বইটা দেখিয়ে বললাম, ” আপু এই বইটা মেঝে তে পড়ে ছিল। ”
তিনি বললেন, হায় হায়, এই বইটা আমার খুব প্রিয়।
মেডিকেলে পড়ার পুরো সময়ে আমি এই বইটা পড়তাম।
পরীক্ষার সময় ভালো রেজাল্ট এর আশায় এই বইটা ছিল আমার সম্বল।
রুম পরিষ্কার করতে যেয়ে, ” এই বইটা কখন যে মেঝেতে ফেলে দিয়েছে, আমি কিছুই জানিনা।
তুমি বইটা যত্ন করে রেখে দিয়েছো, thank u Apu.
বইটা আমার আর লাগবেনা। আমার বাসায় এমন আরোও অনেক বই আছে। বইটা তুমি নিয়ে নাও। আমি জানি তোমার কাছে যত্নে থাকবে। ”
এই কথা গুলো বলে, উনি আমার গালে হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। আমাদের সেই সিনিয়র আপু ছিলেন, আমাদের নিজেদের বোনের মতো।
আনন্দ কষ্ট, সুখ দুঃখ সব সময় আমাদের পাশে থাকতেন।
আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন, ” মোবিন তুমি মন দিয়ে লেখাপড়া করো। তোমার বাবা নায়, তোমাকে অনেক বড়ো ডাক্তার হতে হবে । ”
আমাকে মেডিকেল কলেজের অধিকাংশ মানুষ আমাকে
” মোবিন ” নামে ডাকতো।
আপু চলে যাবার সময় আমাদের সবার খুব মন খারাপ হয়ে গেছিল। আমরা সবাই চোখের পানি মুছতে মুছতে আপুকে বিদায় জানিয়েছিলাম।
উনার উপহার দেয়া বইটা আমি এতো বছর ধরে পরম মমতায় আগলে রেখেছি। এই বইটার সাথে আমার হসপিটালের কলিগরা খুব বেশী পরিচিত।
এই বইটা Square Hospital এর আট তলার ডক্টরস রুমের লকারে বসবাস করেছে দীর্ঘ সাত বছর। আমার নাইট ডিউটি তে মাঝে মাঝে এই বইটা পড়ার জন্য লকার থেকে বের করতাম ।
এই বই থেকে ইয়াসিন সূরা পড়তাম। সব সময় পড়ার সুযোগ হতোনা। আমার অধিকাংশ কলিগ, হসপিটালের সিস্টার সহ আরোও অনেকেই জানেন, এই বইটা আমার খুব প্রিয়।
এই বইটা আমাদের অভিভাবক আর বন্ধুসুলভ একজন সিনিয়র আপুর উপহার দেয়া। পুরে বই জুড়ে আমার মেডিকেল কলেজের স্মৃতি, হোস্টেল জীবনের হাজারো সপ্নের মুহূর্ত।
আমি ভীষণ স্মৃতিকাতর। অধিকাংশ মানুষ পুরোনো জিনিস গুলো ফেলে দেয়। আর স্মৃতিমাখা জিনিস গুলোর প্রতি আমার থাকে অবাধ ভালোবাসা।
এই বইটার পেজ মারকার হিসাবে ব্যবহার করি ২০০৬ সালের গ্রামীণ ফোনের ( মোবাইল) একটা সবুজ রঙের কার্ড। এখন এই ধরনের কার্ড গুলো আর পাওয়া যায় না ।
এই কার্ডটাও একটা স্মৃতি ।
আমি ধর্ম জাহির করতে পছন্দ করিনা। ধর্মের কথা সাধারণত ফেসবুকে লিখিনা। কিন্তু স্মৃতি চারণ করতে যেয়ে অনেক না বলা কথা বলতে হয়।
প্রিয় আপু,
আপনি যেখানেই থাকেন, আমি যতোবার এই বইটির সূরা গুলো পড়বো, আল্লাহ যেন তার থেকেও বেশী সংখ্যক সওয়াব আপনার আমলনামায় লেখে দেয়।
এই বইটার মিশে আছে আমার অগণিত দিনের চোখের পানি। আমি হোস্টেলে থাকাকালীন সময়ে, এই বইটা পড়তাম। আর মোনাজাত করতাম, ” আল্লাহ আমার ভাই বোন কে তুমি আদর্শ মানুষ বানিয়ে দাও। আমার মা, আত্মীয় স্বজন… কে তুমি ভালো রাখো। আমার বাবা কে জান্নাতবাসী করো…! ”
আমি যখন মেডিকেল কলেজে পড়তাম, তখন আমার ভাই পড়তো রাজশাহীর সারদা cadet কলেজে।
আমার বোন লেখাপড়া করতো রাজশাহী তে। লেখাপড়ার জন্য তিন ভাই বোন তিন জায়গায় ছিলাম। আমাদের তিন ভাই বোনের জন্য খুব মিল ছিল। আমার মন টা তাদের জন্য ছটফট করতো। তখন মন খারাপ হলেই এই বই এর ইয়াসিন সূরা পড়তাম।
এখনো পড়ি।
বাজারে এই ধরনের অসংখ্য বই আছে। কিন্তু এই বইটি আমার কাছে ভীষণ প্রিয়। বইটার পৃষ্ঠা গুলো লালচে হয়ে গেছে, তবু বইটি আমার কাছে চির সবুজ।
এই ” পাঞ্জে সূরা অজিফা ” বইটি জুড়ে, আমার মেডিকেল জীবনের স্মৃতি, স্কয়ার হসপিটালের কর্মমুখর দিন, আমার হোস্টেল জীবন আর অনেক বড় মাপের চিকিৎসক হবার গভীর সপ্নে বিভোর একান্ত এই আমি…!!!
ফারহানা মোবিন
চিকিৎসক, লেখক ও উপস্থাপিকা